ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নারীর স্বাধীনতা

পাক বর্বরতার শিকার বীরাঙ্গনাদের দুর্দশা কাটেনি আজও

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০২১
পাক বর্বরতার শিকার বীরাঙ্গনাদের দুর্দশা কাটেনি আজও

গোটা দেশ মেতে উঠছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে। লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ আর মহান মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের পাশাপাশি বীরাঙ্গনাদের অবদানও উল্লেখযোগ্য।

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের শিকার, শত-সহস্র বীরাঙ্গনা আজও বয়ে চলেছেন খান সেনার অত্যাচারের ভয়াবহ স্মৃতি। জীবনের সমস্ত কিছু খুইয়েও শান্তিতে নেই তারা। প্রিয় দেশের জন্য নারীদের সেই আত্মত্যাগ দেশবাসীর করুণা বা সহানুভূতির কিছুটা জন্ম দিলেও সমাজ আজও স্বীকৃতি দেয়নি বীরাঙ্গনাদের। বরং জুটেছে নষ্ট মেয়ের তকমা।

সাহসী নারী বা ব্রেভ উওম্যানকে বাংলাদেশ সরকার বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই বীরাঙ্গনারা পাক-বাহিনীর ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার। তবে বীরাঙ্গনা শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অসম্মান বা সন্ত্রাসের শিকার নারীর দুর্দশার কথা। ধর্ষণ, গর্ভপাত, আত্মহত্যা, যুদ্ধ প্রভৃতি শব্দ উঠে আসে বীরাঙ্গনা শব্দটি শুনলেই। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অন্তত ২ লাখ নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। এদের অনেকেই সন্তান প্রসবের জন্য ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকে আবার ভ্রুণহত্যা না করে নিজেকেই হত্যা করেছেন। পরিবার  বা সমাজে ধর্ষিতার কোনও স্থান নেই। তাই পাকিস্তানি বর্বরতার শিকার বীরাঙ্গনারা অনেকেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধকালে হজম করতে হয়েছে রাজাকার, আল-বদর আর পাক-সেনার যৌন সন্ত্রাস। আর এখনও বয়ে চলতে হচ্ছে অসম্মান আর উপেক্ষা।

বীরাঙ্গনা আলেয়া বেগম শোনাচ্ছিলেন তার করুণ কাহিনী। একাত্তরে তার বয়স ছিল মাত্র ১৩। তার আপা লাইলির সঙ্গে তাকেও তুলে নিয়ে যায় খান সেনা। ৭ মাস ধরে চলে যৌন সন্ত্রাস। চোখের পানি মুছতে মুছতে আলেয়া বলেন, খানেরা আমাদের দুহাত পিঠমোড়া করে বেঁধে চালাতো অত্যাচার। সিগারেটের আগুনে ঝলসানো হতো আমাদের মুখ। গোটা শরীর ঝলসে উঠতো সিগারেটের ছ্যাঁকায়। চলতো গণধর্ষণ। আমার মতো হাজারো নারীকে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার ধর্ষণের শিকার হতে হতো। ক্রমাগত অত্যাচারে ফুলে ওঠে আমার শরীর। চলাফেরার করার শক্তিটুকুও হারাই। এখনও আমি একা চলাফেরা করতে ভয় পাই। পাক-সেনারা আমাদের বেচে থাকার শক্তিটাকেই ছিনিয়ে নিয়েছে। দু-মুঠো ভাত পর্যন্ত জুটতো না আমাদের। দিনে একবার নামমাত্র সব্জি দিয়ে শুকনো দিতো আমাদের। খানদের পাশাপাশি বিহারীরাও আমাদের ওপর জুলুম চালাতো। আমরা পালাবার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। ওদের কাজ ফুরোতেই আমাদের অনেককে মেরে ফেলেছে ওরা। আলেয়াকেও গুলি করেছিল পাক-সেনা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। আলেয়া যখন ঘরে ফেরে তখন সে ছিল ৫ মাসের পোয়াতি। জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই আলেয়ার সন্তান মারা যায়। তার কথায়, ঘরে ফিরতেই আমি নষ্ট মেয়ে বলে পরিচিতি লাভ করি। গ্রামের সবাই আমার নামটাই দিয়ে দেয় নষ্ট মেয়ে। সহ্য করতে পারিনি গ্রামবাসীদের অপমান আর লাঞ্ছনা। ঢাকায় চলে যাই। বেছে নিই পরিচারিকার জীবিকা। শুরু করি নতুন করে লড়াই।

নিজের অতীত গোপন রেখে বিয়ে করেছিল সে। স্বামী পরে সব জানতে পেরে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল। অত্যাচারও করে তার ওপর। কিন্তু তার মেয়ে পাশে দাঁড়ায়। বাবাকে বোঝায়। বাইরের লোক যাতে আলেয়ার অতীত জানতে না পারে সেই শর্তে এখনও সংসার টিকে আছে। ভয় শুধু সংসার নিয়েই নয়। লোকে তার অতীত জানতে পারলে তো ফের শুরু হবে হাসি-ঠাট্টা! তামাশার খোরাক হবে সে, তাই ভয় সমাজকেও।  

আলেয়ার ক্ষোভ রয়েছে সরকারের ওপরও। তার অভিযোগ, বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে কিছুই করেনি সরকার। তিনি বলেন, আমরা সরকার থেকে কোনও সাহায্য পাইনি। এরজন্য আমার মনেও অনেক ক্ষোভ রয়েছে। আমাদের জীবনের কি কোনও দাম নেই? এই জীবন নিয়ে আমি এখন কী করবো? লোকে আমাদের অন্য চোখে দেখে। তাই কাউকে কিছু বলতেও পারি না।

আলেয়ার আপা লাইলি বেগমকে যখন খানেরা অপহরণ করে, তখন সে ছিল গর্ভবতী। তার গর্ভের শিশুটি মারা যায়। পরে লাইলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিজেও নামে রণাঙ্গনে। কিন্তু তার আত্মত্যাগ আজও স্বীকৃতি পায়নি।  তিনি বলেন, আমরা তো সবকিছুই খুইয়েছি। স্বামী, সন্তান, সংসার, ইজ্জত সবই খোয়া গেছে। এইসব তো হারানোর কোনও কথা ছিলো না। আমরা চাইনি এ জীবন। আমাদের মনেও তো ছিল ঘৃণার আগুন। খানদের খুন করে আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। হেমায়েত বাহিনীর হয়ে আমরাও লড়াই করি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। ইতিহাসের পাতায় কোথায় আমাদের নাম? কোনও তালিকাতেই উল্লেখ নেই আমাদের কথা। কেউ আমাদের ধন্যবাদটুকুও জানাতে নারাজ। আমাদের বরাতে জুটেছে শুধু ঘৃণা, লাঞ্ছনা আর অপমান।

তবে আলেয়ার ১৫ বছরের মেয়ে আসমা আকতার একা কিন্তু তার মা-মাসির জন্য গর্বিত। সমাজ তাদের যতই ঘৃণা করুক আসমার চোখে তার মা-মাসি মহান। বীরাঙ্গনার মেয়ের বুকের লুকনো যন্ত্রণা কেউ সহজে দেখতে পায় না। সেটা ভালোই টের পাচ্ছে সে। সেই বেদনায় ভর করে সে রচনা করেছে গান। সেই গানেই ফুটে উঠছে দু-লাখেরও বেশি বীরাঙ্গনার মর্মগাথা।

বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের প্রতি অনেকেরই করুণা বা সহানুভূতি রয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু শুধু করুণা বা সহানুভূতি চায়না আলেয়ারা। তারা চায় সমাজ তাদের যোদ্ধার মর্যাদা দিক। যুদ্ধের নায়কদের মতো তারাও চাইছেন মুক্তিযুদ্ধে নিরস্ত্র নারীদের অবদানও স্বীকৃত হোক বাংলাদেশে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পাক-বর্বরতার শিকার মা-মাসিদের প্রতি সম্মান ও স্বীকৃতি দুটোই দেখাক মাতৃভূমি। এটাই চাইছে আসমারা। আসমাদের সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বীরাঙ্গনারা কি দেশবাসীর কাছে এইটুকু প্রত্যাশা করতে পারে না?

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০২১
নিউজ ডেস্ক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।